ইংরেজি ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষ ভাগ
অর্থাৎ বাংলা ১৩৭৮ সালের শ্রাবণ মাসের প্রথম ভাগ।
আমার বাবা তার কয়েকজন চাচাত ভাইদেরকে
নিয়ে যুদ্ধ শুরু হবার ৩ মাস পর মুক্তিযুদ্ধে
যোগ দেন।
তারা এর আগে যাবেন ভারতে এবং ভারত থেকে
ট্রেনিং নিয়ে আসবেন বাংলাদেশে।
এই কারণে সিরাজ কাকা, শুকুর কাকা, বাঁকা কাকা, বটু কাকা এবং
আজিজর কাকা সহ আমার বাবা
ভোর বেলা রওয়ানা করেন ভারত এর উদ্দেশ্যে।
তাদের ইচ্ছা যে,তারা ভারতে হেটে
হেটে যাবেন।
হাটতে শুরু করার প্রায় ৮-৯
ঘণ্টা পর তারা পৌঁছে গেল মধুমতীর তীরে। মধুমতী পার হয়ে তারা ইতনা
গ্রামে পৌঁছে যান। ইতনা গ্রামের
উপর দিয়ে যেয়ে তারা পৌঁছে যান লোহাগড়া বাজারে।
বাজারের পাশে ছিল স্কুল। তারা রাতে ঐ স্কুলে
রাত অতিবাহিত করেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য যে পিছু ছাড়েনা।
রাতেই সেখানে চলে আসে রাজাকারেরা। রাজাকারেরা ঐ
স্কুলে আশ্রয়-রত হিন্দু মহিলাদের সাথে আনা
সব টাকা পয়সা সহ সব গহনা নিয়ে নেয়। ঐ সময় রাজাকারদের
ধোঁকা দিতে বাবা ও চাচারা
লুঙ্গি মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকেন। কিছু সময় পায়চারি
করার পর রাজাকাররা চলে যায়। ঐ দিন কোন মতে
রাত কাটান তারা।
পরদিন আবার তারা হাটতে শুর“ করেন। পৌঁছে যান যশোরে। যাবার সময় দুপুরে
কোন কিছুই খাওয়া
হয়না।যশোর থেকে বর্ডার
পার হয়ে ভারতের বনগাঁ নামক স্থানে রাত কাটান এক হোটেলে। হোটেলে
থাকতে হলে টাকা দিতে হবে তাই তারা টাকা
দিয়ে হোটেল ঘর ভাড়া করল।
ঐ হোটেলে রাতে খাওয়া দাওয়া করে দোতলার
এক ঘরে ঘুমাতে যান ঠিক তখনই শুনতে পান কোন একজন ব্যাক্তি বলছেন কখন আসব?” ঐ কথা শুনে বাবা
আর আমার চাচারা তো পুরো ঠাণ্ডা হয়ে গেছেন।
তারা সবাই তখন ভাবতে লাগলেন যে, রাতে মেরে ফেলবে
নাকি।
তারা তখন একটু ভয়ে ভয়ে হোটেল মালিককে
জিজ্ঞেস করল,“কি হয়েছে,কে আসবে?”
সে বলল না কিছুনা কোন ভয় নেই।
পরদিন সকালের দিকে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া
হল এক রেস্ট হাউজে। এটাকে রেস্ট হাউজ না বলে ক্যাম্প
বলাই ভাল।
তো এ ক্যাম্প আবার ভারতের কল্যাণী নামক
জায়গায় অবস্থিত। কল্যাণীতে যেতে হল ট্রেনে চেপে।
এই কল্যাণীতে থাকতে হল আনুমানিক দেড়
মাস বা দুই মাস। এ জায়গায় শুধু পিটি প্রেত করা
হল।
এখান থেকে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল বিহার
রাজ্যের চাকুরিয়া বিমান বন্দরে।
চাকুলিয়াতে যেতে হল পুলিশ ভ্যানে চড়ে। দুপুর ৩টায় রওয়ানা
করে
পরদিন দুপুরে পৌছতে হল চাকুলিয়ায়। যাবার সময় রাতে
থামান হল এক দোকানে।
ঐ দোকানে পাওয়া গেল সিঙ্গারা। আর ঐ সিঙ্গারা
খেয়ে আবার শুরু হল যাত্রা।
চাকুলিয়াতে খেতে দেয়া হল রুটি আর খাওয়া
যায়না এমন ডালডা,হলুদ,ডাল দিয়ে রান্না বললে ভুল
হবে এমন তরকারি বা ডাল।
কিন্তু কি করার!!!পেট বাচাতে খেতে তো
হবেই।
তবে খুশির খবর ছিল এটাই যে ওখানে দোকানে
১০ পয়সা দামের পাউরুটি পাওয়া যেত।
আর মন ভাঙ্গা খবর এটাই ছিল যে,যুদ্ধের সময় সুতরাং
টাকা পয়সার সংকট আছে তাই রুটি কিনে
খাওয়াটা কমই হত!!!
যেদিন তারা চাকুলিয়াতে পৌঁছলও ঐদিনই
তাদেরকে ১০ থেকে ১১ মাইল নিয়ে যাওয়া হল তাও
আবার না হাঁটিয়ে না দৌড়িয়ে। এ সময় অনেকেই
হাত পা ছেড়ে পড়ে যেত। আর তাদেরকে নিয়ে
আসতে হচ্ছে অন্যের অন্য কারো সাহায্য
নিয়ে।
এ সময় অনেকেই ভাবতে লাগলেন যে হয়তো মেরেই
ফেলবে!!!
আবার বাবা একজন পরিশ্রমী এবং একগুঁয়ে
প্রকৃতির। তিনি কখনোই তার শরীর নিয়ে ভাবতেন।
এক সময় তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল ফায়ারিং
বাট এ।
যাবার পর বলা হল বুলেট খুঁজতে। সবাই তখন মাটি
খুড়ে খুড়ে খুঁজে নিয়ে আসে বুলেট। সবাই
কিছুনা কিছু আনে। বুলেট জমা দেবার
পর শুরু হল আবার সেই দৌড়।
কিছু দূর আগাবার পর তাদের খেতে দেয়া
হল ভাত। এই চুল এসেছে রাশিয়া থেকে।
এই ভাত এমনই ভাত যা খাওয়াও যায়না আবার
গেলাও কষ্ট।
তবে ক্ষুধার্ত পেটে ঐ ভাত-ই তাই কতনা
ভাল লাগত।
খাওয়া শেষে বলা হল ঘুমাতে যেতে। এ সময় এক হিন্দুস্থানি
বলেলন যাও আরাম কারো। আরও বলা হল
হুইসল দিলে মাঠে চলে আসতে”।
ঘুমাতে বলা হল তাবুতে। আর তাঁবুর চারপাশে
আছে ১ ফুট চওড়া ১ ফুট গভীর নালা। বিহারের বিষাক্ত
কাঁকড়া বিছার হাত থেকে রা পেতে এই ব্যবস্থা। একটা ইট এর উপর
নিজের জামা কাপড় রেখে বালিশ বানান
হত।
এও এক শান্তির ঘুম।
ঘুমাতে না ঘুমাতেই আবার হুইসল বেজে উঠল। হুইসল বাজল ভোর
৪টায়।
সবাই
উঠে চলে গেল মাঠে
শুর“ হল ট্রেনিং।
এভাবে চলল ২১ দিন বা কিছু বেশি।
এই কয়েকদিনে শিখিয়ে দেয়া হল ফায়ারিং, গ্রেনেড চার্জ, ডেটোনেটর চার্জ
করা ইত্যাদি।
নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে হল ট্রেনিং। এর মাঝে একদিন
নিয়ে যাওয়া হল এক বিশাল বড় পাহাড়ে।
এই পাহাড়ে যেতে সময় লাগে অর্ধেক বেলা
আবার ফিরতেও সময় লাগে অর্ধেক বেলা। অন্য-
আরেকদিন ও নিয়ে যাওয়া হয় আরেক পাহাড়ে।
হঠান ট্রেনিং শেষে এ কমান্ড দেয়া হয়
যে, মুক্তিযোদ্ধাদের
বাংলাদেশে পাঠানো হবে।
কথা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আসা
হয় দত্তপুলিয়া নামের এক গ্রামে।
দত্তপুলিয়ার বর্ডার পার করে তাদের পাঠানো
হবে যশোরে।
সাথে দেয়া হবে ১০০ রাউন্ড গুলি ১০ টি
কাপড়ের পকেটের মত ব্যাগে, একটি করে হ্যান্ড গ্রেনেড ও
একটি করে রাইফেল।
তাছাড়া সাথে দেয়া হয়েছে এস.এম.জি, এস.এলো.আর, থ্রি.নট.থ্রি, মার্ক ফোর, হাই
এক্সপ্লসিভ, রকেট লাঞ্চর ইত্যাদি।।